বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়
জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বজাতীয়তাবাদের উন্মেষে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব : আমরা স্বাধীন বাংলার নাগরিক। আমাদের দেশ এখন পরাধীন নয় স্বাধীন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে টানা নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে স্বাধীন হয় আমার প্রাণের বাংলা।কিন্তু ১৯৭১ সালে সাথে সাথেই বাঙ্গালী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়নি। এই স্বাধীনতা সংগ্রাম বা জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ভাষা আন্দোলনের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
তাই আলোচনা করবো আজকের টিউনে:
বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি হচ্ছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। স্বাধীন বংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলন সুসংহত হয় এবং অগ্রগতি লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাই জনগণের মধ্যে পরবর্তীকালে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং এর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।বাঙালি জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষাকে হাজারগুণে বাড়িয়ে দেয় এ আন্দোলন। তাই ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির গণচেতনার সর্বপ্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ভাষা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
সুদীর্ঘ প্রায় দুইশ’ বছর ব্রিটিশদের অপশাসন ও কুশাসনের অবসান ঘটার পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হলেও শুধু ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।
তবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের আদর্শগত কোনো যোগসূত্র ছিল না বললেই চলে। মূল কারণ হিসেবে বলা যায়, উভয় অঞ্চলের মধ্যকার ভাষাগত বিরোধ।
ভাষাগত বিরোধের কারণে বাংলার জনগণ পাকিস্তানের Fundamental Ideology-র সঙ্গে কখনও একাত্মতা অনুভব করতে সক্ষম হয়নি।
এছাড়া পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি নানাভাবে বৈষম্যমূলক নীতি আরোপ করা হয় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে।
মূলত এসব কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং ১৯৪৭ সালের সেপ্টেন্বরে পূর্ব বাংলায় ‘তমুদ্দুন মজলিস’ নামে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
তমুদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেম। আর সেই ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বাংলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটা পরতে পরতে প্রত্যক্ষ করা যায়। যার সার্থক ফসল আজকের এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট :
বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পেছনে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। নিখিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় পূর্ব বাংলায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়।
যার পরিপ্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেন্বর ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ও ছাত্রের উদ্যোগে ‘তমুদ্দুন মজলিস’ গঠনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় এবং সে আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা আসে বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ভাষা-সংস্কৃতি হারানোর উপক্রম হয়। পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চরম অবজ্ঞা পোষণ করে সেদিন বাঙালি জাতিকে নতুন করে যে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে, তার পরিণাম ছিল ভয়াবহ।
পাকিস্তানি নব্য উপনিবেশবাদী শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই এদেশের নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতনের স্ট্রিম রোলার অব্যাহত রাখে। তাদের প্রথম ফন্দি ছিল কীভাবে বাংলার মানুষের মুখের ভাষাকে ছিনিয়ে নেয়া যায়।
এরই অংশ হিসেবে তারা বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাঙালির ঘাড়ে পাকিস্তানি Culture চাপিয়ে দেয়ার নীলনকশা অঙ্কন করে।
তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক সমাবেশে ঘোষণা দেন; ‘Urdu & Urdu shall be the state language of Pakistan’.
কিন্তু এদেশের ছাত্র-যুবকরা সে সমাবেশেই No, No, It can’t be ধ্বনি তুলে তার এ ধৃষ্টতাপূর্ণ ঘোষণার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানায়।
পাকিস্তানি সরকার সব প্রতিবাদকে পাশবিক শক্তি দ্বারা দমনের চেষ্টা চালায়। তাদের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এদেশের মানুষ।
বাংলার দামাল ছেলেরা শুধু নয়, সর্বস্তরের মানুষ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বজ্র কঠিন শপথ গ্রহণ করে। বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন।
এ আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ায় ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের বাঙালি জনগণ। পূর্ব বাংলায় তিনটি পর্যায়ে আন্দোলন পরিচালিত হয়।
প্রথম পর্যায় :
১৯৪৭ সালের নভেম্বরে করাচিতে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি শিক্ষাবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উর্দুকে গোটা পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ফলে পূর্ব পাকিস্তানের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকায় সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং দাবি পূরণে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নীতি গ্রহণ করা হয়।
সংগ্রাম পরিষদের দাবি ছিল-
১. বাংলা ভাষা হবে পূর্ব বাংলার একমাত্র শিক্ষার বাহন ও অফিস-আদালতের প্রধান মাধ্যম।
২. গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দু। এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই আন্দোলন পরিচালিত হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়:
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্যরা বিশেষত কুমিল্লার একজন সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি জানান।
কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ দাবির বিরোধিতা করেন। ফলে ঢাকায় ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলে চরম অসন্তোষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে। তারপর ২৬ ফেব্রুয়ারি সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়।
সংগ্রাম পরিষদ এভাবে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট ও হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন অব্যাহত রাখে। একপর্যায়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাষার দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে আন্দোলন সাময়িক প্রশমিত হয়।
কিন্তু ১৯৪৮ সালের একুশে মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের একটি জনসভায় এবং কার্জন হলের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পুনরায় ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’
এ ঘোষণার পর আন্দোলন পুনরায় চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদের ঝড় প্রবাহিত হয়।
চূড়ান্ত পর্যায় :
ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে রূপ নেয় ১৯৫০ ও ১৯৫২ সালে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নতুন করে ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’
এতে বাঙালি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং আন্দোলন আরও জোরদার করার শপথ গ্রহণ করে। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি ঘটান।
ফলে ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণীপেশার মানুষের মাঝে নিদারুণ ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়। আন্দোলনের গতিবেগ ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৩০ জানুয়ারি ঢাকার রাজপথে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয় এবং জনসভা করা হয়।
আন্দোলনকে আরও তীব্র ও গতিশীল করার লক্ষ্যে ৩০ জানুয়ারির জনসভায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়।
গঠিত কমিটির সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস হিসেবে পালন এবং দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল কর্মসূচি বানচাল করার লক্ষ্যে তৎকালীন গভর্নর নুরুল আমীন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
সরকারের এ অশুভ কর্মকাণ্ডের দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্ররা গোপন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়, যে কোনো মূল্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে।
পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশের আহ্বান করা হয়।
সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। সে দিন ছাত্রসমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি।
ক্রমান্বয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। ওই সময় প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলছিল ঢাকায়। ভাষার দাবিতে সোচ্চার মিছিলটি জোর কদমে এগিয়ে চলে প্রাদেশিক ভবন অভিমুখে।
সে দিন ঢাকায় প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল।
মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলির আঘাতে একে একে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর প্রমুখ যুবকরা।
বুকের ফিনকিঝরা তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার পিচঢালা কালো পথ।
বাংলার মানুষের রক্তের বন্যায় ভেসে যাওয়া কালি দিয়ে লেখা হয় এক অনন্য ইতিহাস। অবশেষে তীব্র বিক্ষোভের মুখে পাকিস্তান সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
সাময়িকভাবে বাংলাকে অন্যতম জাতীয় ভাষা করার প্রস্তাব প্রাদেশিক পরিষদে উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
তারপর সাংবিধানিকভাবে ১৯৫৬ সালে সংবিধানের ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়।
মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি :
ভাষা আন্দোলন বাঙালির গণচেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ ভূমিকা।
ভাষার জন্য আন্দোলন এবং জীবনদানের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত করা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
বিশ্বের আর কোনো দেশের মানুষের ভাষার জন্য সংগ্রাম ও রক্তদানের ইতিহাস নেই।
তাই ভাষা আন্দোলন বাংলার জনগণের মধ্যে নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করে।
এ আন্দোলনই পর্যায়ক্রমে বাঙালি জাতিকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল, তা পরবর্তী আন্দোলনগুলোর জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা,
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।
সুতরাং ভাষা আন্দোলনই পরবর্তীকালে সব রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পথকে সুপ্রশস্ত করেছে, এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে,
ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি ও চেতনা এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল অনুপ্রেরণা।
স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন প্রক্রিয়া
আজ আমরা আলোচনা করব যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন এর প্রক্রিয়া এবং ধাপগুলো।
১. নতুন রাষ্টের সংবিধান প্রণয়ন:
শেখ মুজিব উনার অন্তর্বর্তী সংসদকে একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব প্রদান করেন এবং চারটি মূলনীতি হিসেবে “জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র” ঘোষণা করেন যা মুজিববাদ নামেও পরিচিত।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে শেখ মুজিব স্বাক্ষর করেন ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের ঘোষণা দেন ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার;
১৬ ডিসেম্বর থেকে নতুন সংবিধান কার্যকর করা হয় এবং ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শেখ মুজিব ঢাকা-১২ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকার গঠন করেন।
২. নতুন রাষ্ট্র পুনর্গঠন:
১৯৭১ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নয় মাস ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর সমগ্র বাংলাদেশ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। শেখ মুজিবুর এই ধ্বংসযজ্ঞকে “মানব ইতিহাসের জঘন্যতম ধ্বংসযজ্ঞ” উল্লেখ করে ৩০ লাখ মানুষ নিহিত ও ২ লাখ নারীর ধর্ষণ হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।
১৯৭২ শেখ মুজিব মাত্র এক বছরের মধ্যে দেশ পুনর্গঠনের জন্য উল্লেখযােগ্য কর্মসূচি হাতে নেন।
- প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন,
- সংবিধান প্রণয়ন,
- এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন,
- যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন,
- শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ,
- শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং
- মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ,
- মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন,
- ১১,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ৪০,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ,
- দুঃস্থ মহিলাদের কল্যাণের জন্য নারী পুনর্বাসন সংস্থা,
- মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন,
- ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ,
- বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ,
- পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও চালু করার মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারীর কর্মসংস্থান,
- ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্প-কারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যার মোকাবেলা করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা
এই সকল কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস চালান।
তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে আঁতাতের অভিযোগে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুনরায় চালু করেন।
ইসলামি গোত্রগুলোর জোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মদ তৈরি ও বিপণন এবং জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করেন। অত্যন্ত অল্প সময়ে প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযােগ্য সাফল্য।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়া হয়। ১০০ বিঘার বেশি জমির মালিকদের জমি এবং নতুন চর বিনামূল্যে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা হয়।
গ্রাম বাংলার ঋণে জর্জরিত কৃষকদের মুক্তির জন্য তিনি “খাই-খালাসী আইন” পাশ করেন। গ্রাম বাংলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও শিল্প-কৃষি উৎপাদনের জন্য পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বাের্ড প্রতিষ্ঠা করেন।
বঙ্গবন্ধু স্থানীয় সরকারগুলোতে গণতন্ত্রায়নের সূচনা করেন। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ পৌরসভায় গণভােটে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে প্রশাসনে জনগণ অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি নাগাদ ১৩ মাসে ১০ কোটি টাকা তাকাবি ঋণ বণ্টন, ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ প্রদান, কৃষিক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন, ১০ লাখ বসতবাড়ি নির্মাণ, চীনের কয়েক দফা ভেটো সত্ত্বেও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ, ৩০ কোটি টাকার রিলিফ বিতরণ, ২ ফেব্রুয়ারি থেকে মিত্রবাহিনীর সৈন্য প্রত্যাবর্তন শুরুসহ দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বিশাল কর্মযজ্ঞের আয়ােজন করেন।
৩. অর্থনৈতিক নীতি:
নব নির্বাচিত মুজিব সরকার গুরুতর কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যার মধ্যে ছিল, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর পুনর্বাসন, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা উপকরণ সরবরাহ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়াবলি।
এছাড়া ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এবং যুদ্ধের ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও চরমভাবে ভেঙে পড়েছিল।
অর্থনৈতিকভাবে, মুজিব একটি বিস্তৃত পরিসরের জাতীয়করণ কার্যক্রম হাতে নেন।
বছর শেষ হতেই, হাজার হাজার বাঙালি পাকিস্তান থেকে চলে আসে, হাজার হাজার অবাঙালি পাকিস্তানে অভিবাসিত হয়, এবং এরপরও হাজার হাজার মানুষ শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে রয়ে যায়।
প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করার জন্য বৃহৎ সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকে এবং দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কাকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়।
৪. পররাষ্ট্র নীতি:
চার বছরের কম সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নে যে সাফল্য এনেছেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এখনো অদ্বিতীয় হয়ে আছে।
যেসব দেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তাদের সঙ্গেও তিনি বন্ধুত্ব স্থাপন করেছেন। এমনকি পাকিস্তানের স্বীকৃতিও আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
“কারো সাথে বৈরিতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্ব” ছিল মুজিব সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ প্রায় ১১৩টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করে।
শেখ মুজিবের সিদ্ধান্তক্রমে বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সদস্যপদ গ্রহণ করে।
বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভের পর শেখ মুজিব পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং ওআইসি, জাতিসংঘ ও জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনে বাংলাদেশের সদস্যপদ নিশ্চিত করেন।
৫. সামরিক বাহিনী গঠন:
শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী গড়ে ওঠে। নবগঠিত রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে তিনি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য বিস্তৃত প্রকল্প গ্রফন করেন।
শেখ মুজিব খাদ্য ক্রয়ের পাশাপাশি বিদেশ থেকে সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ও সামরিক সামগ্রী সংগ্রহ করেন।
যুগোস্লাভিয়ায় সামরিক প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে পদাতিক বাহিনীর জন্য আনা হয় ক্ষুদ্র অস্ত্রশস্ত্র এবং সাজোঁয়া বাহিনীর জন্য ভারি অস্ত্র।
ভারতের অনুদান ৩০ কোটি টাকায় সেনাবাহিনীর জন্য কেনা হয় কাপড় ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। সােভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মিগ বিমান, হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমান সংগ্রহ করা হয়।
৬. জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন:
শেখ মুজিবের ক্ষমতালাভের পরপরই, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-এর সশস্ত্র বিভাগ গণবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত বামপন্থী বিদ্রোহীরা মার্ক্সবাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।
গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা রোধে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তন করে ক্ষমতা গ্রহণের পর ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের ব্যাপরে একটি আদেশ জারি করেন।
এরপর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনের সরকারি আদেশ জারি করা হয়।
রক্ষীবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল সেনাবাহিনীর ছয় ভাগের এক ভাগ। শুরুর দিকে রক্ষীবাহিনী বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অনেক অস্ত্রশস্ত্র, চোরাচালানের মালামাল উদ্ধার করে এবং মজুতদার ও কালোবাজারীদের কার্যকলাপ কিছুটা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।
৭. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা:
স্বাধীনতা পর অচিরেই মুজিবের সরকারকে ক্রমশ বাড়তে থাকা অসন্তোষ সামাল দিতে হয়। তার রাষ্ট্রীয়করণ ও শ্রমভিত্তিক সমাজতন্ত্রের নীতি প্রশিক্ষিত জনবল, অদক্ষতা, মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি আর দুর্বল নেতৃত্বের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মুজিব অতিমাত্রায় জাতীয় নীতিতে মনোনিবেশ করায় স্থানীয় সরকার প্রয়োজনীয় গুরুত্ব লাভে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ ও কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ করায় গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে।
এ সময় তৃণমূল পর্যায়ে কোন নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয় নি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে কমিউনিস্ট এবং ইসলামপন্থীরা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করায় ইসলামপন্থীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ পদে আপনজনদের নিয়োগ দেয়ার জন্য মুজিবের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনা হয়।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষ খাদ্য সংকট আরও বাড়িয়ে দেয় এবং অর্থনীতির প্রধান উৎস কৃষিকে ধ্বংস করে ফেলে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব, দ্রব্যমূল্যের অসামঞ্জস্যতা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে মুজিবকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সংঘাতের মাত্রা বাড়তে থাকায় মুজিবও তার ক্ষমতা বাড়াতে থাকেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মুজিব জরুরি অবস্থা জারি করেন।
এভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী বাংলা পুনগর্ঠনে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ নির্মানে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন।
No comments:
Post a Comment